নিজস্ব প্রতিবেদক: এবারও বসবে না বৈশাখী মেলা। অথচ আর দুইদিন পরেই পয়লা বৈশাখ। এবারও মেলা পাচ্ছে না শখের হাঁড়ি। করোনাভাইরাসের কারণে গতবছরও বসেনি বাঙালীর প্রাণের মেলা। তাই অলস সময় পার করছেন সুশান্ত পাল। গত প্রায় ৩১ বছর ধরে শখের হাঁড়ি তৈরি করে আসা সুশান্ত পাল।

রাজশাহী পবা উপজেলার বসন্তপুর গ্রামে সুশান্ত কুমার পালের বাড়ি। গতকাল শনিবার বিকালে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনের মোড়ের দোকানেই বসে আছেন সুশান্ত পাল। জানতে চাইলে তিনি বলেন, এবারও বসবে বৈশাখী মেলা। তাই ব্যস্ততা তেমন একটা নেই। টুকটাক হাঁড়ি তৈরি করছি। আর সেই হাঁড়িতে তুলি দিয়ে রং করছি। যদি কেউ শখের হাড়ির অর্ডার করে সেই আশায়।

বংশগতভাবেই শখের হাঁড়ি তৈরির কারিগর হয়েছেন সুশান্ত পাল। তার বয়স এখন ৬০। প্রায় ৩১ বছর ধরে নিজের হাতে তৈরি করছেন শখের হাঁড়ি। দেশব্যাপী ছড়িয়েছে এই কারুশিল্পীর নাম। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে ‘শখের মৃৎশিল্প’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধের সঙ্গে ছাপানো হয়েছে সুশান্ত পালের ছবি। সরকারি খরচে দেশের প্রতিনিধি হয়ে গিয়েছেন বিদেশেও।

২০১৩ সালে কারুশিল্পের এক প্রদর্শনীতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হয়ে জাপান গিয়েছিলেন সুশান্ত। তিনি একাধিকবার দেশের সেরা কারুশিল্পীর পুরস্কার পেয়েছেন। কারুশিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ কারুশিল্প পরিষদ, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, জাতীয় জাদুঘর, কারিকা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনসহ (বিসিক) আরও নানা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সনদ রয়েছে তার।

বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী হিসেবে ২০১১ সালে স্বর্ণপদক পান সুশান্ত পাল। বিসিক নকশা কেন্দ্রের ‘আলিয়ঁস ফ্যঁসেজ দো ঢাকা’ জাতীয় মৃৎশিল্প প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ প্রতিযোগী হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন। শুধু বিসিকই সুশান্ত পালকে দুইবার শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী নির্বাচিত করেছে। সুশান্ত কুমার পালের ছেলে সঞ্জয় কুমার পালও সরকারি খরচে ২০১৬ সালে শ্রীলঙ্কায় প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। কারুশিল্পের আরেক প্রদর্শনীতে ২০২০ সালে গিয়েছেন নেপাল।

সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে দেশে যেখানেই কারুশিল্পের মেলা বা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়, সেখানেই সুশান্ত পাল আর তার দুই ছেলেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অসংখ্য প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন তারা। সর্বশেষ গেল মার্চ মাসজুড়ে সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন চত্বরে আয়োজিত লোক কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব থেকে অংশ নিয়ে এসেছেন তারা।

সুশান্ত কুমার পালের ছেলে সঞ্জয় কুমার জানালেন, করোনার কারণে সোনারগাঁয়ে মেলায় তেমন বেচাবিক্রি হয়নি। ফেরত এসেছে শখের হাঁড়ি। করোনাকাল না হলে কিছুই ফিরে আসত না। মেলা শেষের আগেই তাদের শখের হাঁড়ি শেষ হয়ে যেত। বৈশাখী মেলার প্রস্তুতি নিতে বাড়িতেও চলত কর্মযজ্ঞ। দুবছর ধরে চিত্র ভিন্ন।

সঞ্জয় কুমার পাল ও তার ভাই মৃত্যুঞ্জয় কুমার পাল কারুশিল্পী হয়ে উঠেছেন বাবা সুশান্ত কুমার পালকে দেখে দেখে। সুশান্ত পাল শিখেছিলেন তার বাবা বাবা ভোলানাথ কুমার পালের কাছে। ভোলানাথ মারা গেছেন। সুশান্তের স্ত্রী মমতা রানী পাল, মেয়ে সুচিত্রা রানী পাল এবং দুই ছলের স্ত্রী মুক্তি রানী পাল ও করুণা রানী পালও এখন কারুশিল্পী। প্রতিবছর বৈশাখের আগে তাদের ব্যস্ততার সীমা থাকে না। দিনরাত এক করে তারা কাজ করেন। করোনার থাবায় এবার কারও কোন ব্যস্ততা নেই। গতবছরও একই অবস্থা ছিল। বাড়িতে এখন তাদের হাঁড়ি-সাজি, পঞ্চসাজি, চুকোই, মাটির পুতুল, ঘোড়াসহ অন্যান্য মাটির তৈজসপত্রের মজুতও কম। অথচ এই বাড়িরই ঘরে ঘরে, বারান্দা আর আঙ্গিনায় দৃষ্টিনন্দন এসব জিনিসপত্র আগে সাজিয়ে রাখা হতো।

গতকাল শনিবার বিকালে কিছু শখের হাড়িতে তুলি দিয়ে আলপনা আঁকছিলেন সুশান্ত পাল। সুশান্ত পাল জানালেন, গতকাল শনিবার সকালে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা তার বাড়ি পরিদর্শনে আসবেন। সে কারণে এসব বের করে রাখা হয়েছে। সুশান্ত বললেন, লম্বা সময় ধরে বসে বসে হাঁড়ি তৈরির কাজ করার কারণে কোমরে-পায়ে ব্যাথা হয়েছে। এখন চলতে হয় লাঠি নিয়ে। উন্নত চিকিৎসা করাতে পারছেন না। করোনার কারণে সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে।

গতকাল শনিবার সকালে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক ড. আহমেদ উল্লাহ ও উপ-পরিচালক মো. রবিউল ইসলাম সুশান্তের বাড়ি পরিদর্শনে যান। তাদের সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকও ছিলেন। তারা সুশান্তের কারুকাজের প্রশংসা করেন। জরিপের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেন। এ দিন দুপুর পর্যন্ত তারা সুশান্তের বাড়িতে ছিলেন তাঁরা।

মতিহার বার্তা / ইএবি